পার্বত্য চট্টগ্রামে দুই দশক ধরে চলতে থাকা সশস্ত্র বিদ্রোহ নিরসনে ১৯৯৭ সালের ডিসেম্বর মাসে স্বাক্ষরিত পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি বাংলাদেশের জন্য একটি মাইলফলক। এই শান্তি চুক্তির ফলে বাংলাদেশের ভৌগোলিক অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করে পাহাড়ি ও বাঙালি নাগরিকদের মধ্যে এক সম্প্রীতির পরিবেশ ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। এর ফলাফল সুদূরপ্রসারী এবং টেকসই করতে সেনাবাহিনী, বিজিবি, পুলিশ ও র্যাবসহ অন্যান্য প্রশাসন নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। বিভিন্ন কারণে চুক্তিটি বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ অর্জন।
প্রথমত, চুক্তিটি স্বাক্ষর করা না হলে এই দুর্গম অঞ্চলে বিভিন্ন অবকাঠামো, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য, সামাজিক ইত্যাদি অন্যান্য খাতে উন্নয়নমূলক কাজ থেমে থাকত এবং সরকারের সামগ্রিক সেবা পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে অনেক চ্যালেঞ্জ তৈরি হতো যেটি চুক্তি স্বাক্ষর ও বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে দূর হয়েছে। সরকার যদি এই চুক্তিটি স্বাক্ষর ও বাস্তবায়ন না করতে পারত তবে এখানকার জনমানসে বিভিন্ন বৈষম্যনির্ভর অস্থিরতা তৈরি হতে পারত যাকে ব্যবহার করে এই অঞ্চলের নিরাপত্তা আরও নাজুক হয়ে যেত। কৌশলবিদ্যার গ্রিড হাইপোথিসিস ঘরানার তাত্ত্বিকরা ধারণা করেন ব্যক্তিস্বার্থ হাসিল করার উদ্দেশে অনেক সময় সংঘাত তৈরি করা হয় এবং একে জিইয়ে রাখা হয়। পাহাড়ের জনমানসে বিভিন্ন বৈষম্যনির্ভর অস্থিরতা তৈরি করে একে ব্যবহার করে কোনো গোষ্ঠী ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিল করার অপচেষ্টা করত, চুক্তিটি স্বাক্ষর ও বাস্তবায়নের ফলে সেই সম্ভাব্যতা অনেকাংশই দূর হয়েছে।
উল্লেখ্য, সরকারি হিসাব মতে চুক্তিটির মোট ৯৮টি ধারা-উপধারাগুলোর মধ্যে সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন হয়েছে ৮৬টি, আংশিক বাস্তবায়ন হয়েছে ৪টি এবং বাকি ৮টি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াধীন। চুক্তি স্বাক্ষরের ২৬ বছর পর এসে পার্বত্য চট্টগ্রামকে ঘিরে সরকারের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজের গতি-প্রকৃতি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, চুক্তির বিভিন্ন দাবি বাস্তবায়নে সরকারের সদিচ্ছার অভাব নেই এবং তার ফলে জনমানসে বিভিন্ন বৈষম্যনির্ভর অস্থিরতা তৈরি হওয়ারও সুযোগ নেই। এখনও যেসব অনুল্লেখযোগ্য বিচ্ছিন্ন অস্থিরতা রয়ে গেছে তা মূলত আদর্শভিত্তিক বা মতাদর্শগত নয় বরং ব্যক্তি স্বার্থকেন্দ্রিক কিংবা নিতান্তই অর্থলাভ বিষয়ক। ব্যক্তি স্বার্থকেন্দ্রিক আচরণ চরিতার্থ করার ফলে পাহাড়ে চাঁদাবাজি কিংবা অপহরণের অনুল্লেখযোগ্য কিছু ঘটনার খবর আমরা মাঝেমধ্যে পত্রিকা মারফত পাই।
দ্বিতীয়ত, ২৬ বছর পর এসে বিভিন্ন দৃশ্যমান অভাবনীয় উন্নয়নের ফলে পাহাড়ের জনগণের জীবনযাত্রার মান চোখে পড়ার মতো। যে সময়ে এই চুক্তিটি স্বাক্ষর করা হয়েছিল তার পটভূমি আর বর্তমান সময়ের বাস্তবতার চিত্র পাশাপাশি রাখলে আমাদের এটা আরও সহজবোধ্য হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর অধিকার নিশ্চিতে ও সরকারি সেবা প্রদানের নিমিত্তে বিবিধ উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড এখন দৃশ্যমান। সম্প্রতি আগস্ট মাসে ঘটে যাওয়া পাহাড়ি ঢলের কারণে সৃষ্ট বন্যাপরবর্তী ত্রাণ এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় সরকার ও প্রশাসনের দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ আমাদের এই অঞ্চলে সরকারের সেবা প্রদান ও উন্নয়নের সদিচ্ছার কথাই মনে করিয়ে দেয়। উন্নয়নকে বাধা দিতে সন্ত্রাসীদের একটি অংশ চাঁদাবাজি কিংবা অপহরণের অনুল্লেখযোগ্য কিছু ঘটনা ঘটিয়ে থাকে। এতে করে মনস্তাত্ত্বিকভাবে পাহাড় ও সমতলের নাগরিকদের যে সম্প্রীতির পরিবেশ তৈরি হয়েছে তার দিকে একটা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হতে পারে। পাহাড়ের টেকসই উন্নয়ন ও তার দেখভাল তাই যত শক্তিশালী হবে ততই মনস্তাত্ত্বিক গ্যাপ তৈরি করে সন্ত্রাসীদের পাহাড়কে অস্থিতিশীল করার কৌশলটি দুর্বল হবে।
তৃতীয়ত এই অঞ্চলটি দুর্গম ও ভূ-রাজনৈতিকভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ যার সঙ্গে মিয়ানমার ও ভারতের সংযোগ রয়েছে। ভারত ও মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সমস্যা কখনো কখনো বাংলাদেশের জন্যও ভোগান্তির কারণ হতে পারে যার ফল আউট বাংলাদেশকেও বহন করতে হতে পারে। মিয়ানমার কর্তৃক এর রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর জাতিগত নিধনের প্রক্রিয়াটি আমাদের সেই কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। যদিও সীমান্তে বিজিবি নিরাপত্তা নিশ্চিত করে আসছে তারপরও ভৌগোলিক দুর্গমতার কারণে এবং পর্যাপ্ত অবকাঠামো না থাকার কারণে সেটি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে। এই সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে উঠতে বাংলাদেশ ১ হাজার ৩৬ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্ত সড়ক নির্মাণ করছে, যার মধ্যে ১৭৪ কিলোমিটার নির্মাণকাজ ইতিমধ্যেই সম্পন্ন হয়েছে। এটির নির্মাণ শেষ হলে এই অঞ্চলের দুর্গমতা দূর হবে, ক্রসবর্ডার ইনসারজেন্সি ও বিভিন্ন ট্রান্সন্যাশনাল অর্গানাইজড ক্রিমিনাল নেটওয়ার্কের বিচরণ কমিয়ে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি মানুষের অর্থনৈতিক ও জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে আরও সক্রিয় ভূমিকা পালন করবে স্থানীয় প্রশাসন। সীমান্ত সড়ক শুধু অস্ত্র পাচার, চোরাকারবারি ও মাদক পাচার দমন করে সীমান্ত সংরক্ষিতই করবে না বরং পার্বত্য অঞ্চলের অন্যান্য সড়কের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াবে, যার ফলে বাণিজ্যিক, আর্থিক ও সামাজিক উন্নয়নও বাড়বে।
নিরাপত্তাজনিত কারণ দূর করলে এখন যে সংখ্যক পর্যটক পার্বত্য চট্টগ্রামে আসেন তা বহুগুণে বেড়ে যাবে। এর একটা প্রভাব পড়বে পাহাড়ের এখনও অল্পমাত্রায় থেকে যাওয়া অস্থিরতা নিরসনে। সংঘাতের তাত্ত্বিক কারণ হিসেবে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশ্লেষক, বিশেষত রবার্ট জারভিস ও কেনেথ বুল্ডিং, কমিউনিটি পর্যায়ে সংঘাতের কারণ হিসেবে মনস্তাত্ত্বিক বোঝাপড়ার অভাবকে গুরুত্ব দেন। বাঙালি ও পাহাড়ের নৃগোষ্ঠী নাগরিকদের বোঝাপড়ার অভাব যতটা কমানো সম্ভব হবে সংঘাত ও অস্থিরতা নিরসন করার গতি ততটাই বাড়বে। পর্যটন এই সংঘাত ও অস্থিরতা কমানোর এবং পারস্পরিক সম্প্রীতি বৃদ্ধির মেকানিজম হতে পারে তবে সে ক্ষেত্রে অবশ্যই পাহাড়ি নাগরিকদের অধিকার সমুন্নত করেই সেটা করতে হবে।
পার্বত্য চট্টগ্রামে টেকসই শান্তি ও উন্নয়ন একটি চলমান প্রক্রিয়া যার সূচনা হয়েছিল পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তির মধ্যে দিয়ে। দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন আন্তঃরাষ্ট্রীয় ও অন্তঃরাষ্ট্রীয় সংঘাতের ইতিহাস দেখলে আমরা জানি যে এখানে যেসব সংঘাত চলমান সেগুলো দীর্ঘমেয়াদি এবং এই অঞ্চলটি সামগ্রিকভাবে অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে সামরিকায়নে অনেক এগিয়ে যা টেকসই শান্তির উন্নয়নে অন্তরায়। সেদিক থেকে দেখলে বাংলাদেশ একটি ইউনিক কেস এবং একটি অসাধ্য সাধন করেছে এই চুক্তিটি স্বাক্ষর ও বাস্তবায়নের মধ্যে দিয়ে। যার ফলস্বরূপ দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলভিত্তিক সামরিকায়নের মাত্রা কমানোয় ও দীর্ঘমেয়াদি সংঘাত নিরসনে একটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। পাহাড়ি ও বাঙালিদের মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়া, সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ও সম্প্রীতি বজায় এবং জাতি গঠনে চুক্তিটি একটি অনন্য মাত্রা যোগ করেছে।
– মোঃ আলী সিদ্দিকী: সহকারী অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
প্রকাশিত সময়ের আলো [লিংক]