সম্প্রতি তিন দিনব্যাপী আয়োজিত বিজনেস সামিটের শেষ দিনে বিদেশি বিনিয়োগ নিয়ে আশাবাদের কথা শোনা গেছে। দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন দ্য ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার্স অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে তিন দিনের ওই বিজনেস সামিট আয়োজন করা হয়। ওই সম্মেলনে সৌদি আরব, জাপান, যুক্তরাজ্য, চীন, কোরিয়া ও ভারতসহ বিভিন্ন দেশের প্রায় ৩০০ প্রতিনিধি যোগ দেন। এই তিন দিনে মোট ১৭টি প্ল্যানারি সেশনে স্থানীয় ও বিদেশি প্রতিনিধিরা দেশের ব্যবসায়িক পরিবেশে তাদের আগ্রহের পাশাপাশি কিছু প্রতিবন্ধকতাও তুলে ধরেন। বিপুল তরুণ শ্রমশক্তি থাকায় এবং দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার প্রবেশদ্বারের মতো ভূকৌশলগত অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ আরও বেশি এফডিআই আকর্ষণ করবে, এমনটাই সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের ধারণা। তাদের এই ধারণা অমূলক ভাবার কোনো কারণ নেই। ভৌগোলিক অবস্থান, অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং উপযুক্ত কূটনৈতিক তৎপরতার কারণে বাংলাদেশের গুরুত্ব বাড়ছে। এর আগেও প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এ দুটি নিবন্ধে বাংলাদেশের ভৌগোলিক গুরুত্ব বাড়ার কারণ নিয়ে আলোচনা করেছি। এবার প্রেক্ষাপট ভিন্ন হলেও এর সঙ্গে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের মূল হাতিয়ার কূটনৈতিক তৎপরতার সরাসরি যোগসূত্র এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। যেকোনো রাষ্ট্রের কূটনৈতিক তৎপরতার বড় অংশজুড়ে থাকে নিজ রাষ্ট্রের ব্যবসায়িক ও অর্থনৈতিক পরিসর বাড়ানো। বিজনেস সামিটে বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা এসেছেন এবং বাংলাদেশের ব্যবসায়িক পরিবেশ পর্যবেক্ষণ করে গেছেন। তারপরও বিদেশি বিনিয়োগের পথ সুগম করার জন্য দেশের কূটনৈতিক মহল এবং আমলাতন্ত্রের সমন্বয় জরুরি।
স্বাধীনতার পর ধ্বংসস্তূপ থেকে একটি নতুন রাষ্ট্র গড়ার কাজে নেমে পড়তে হয়েছিল আমাদের। যুদ্ধের পর বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ সংস্থার অনেক প্রতিনিধি এসে আমাদের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে গেছেন। তাদের অধিকাংশই বলেছেন, এই দুরবস্থা দূর করতে আরও একশ বছর আমাদের পরিশ্রম করতে হবে। কিন্তু সেসব অনুমান ভুল প্রমাণিত করে বাংলাদেশ আজ বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র। ভূ-রাজনৈতিক দিক থেকে বাংলাদেশের গুরুত্ব বাড়ছে বলে বিভিন্ন দেশের গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব বাংলাদেশ সফর করছেন। এমনকি দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়েও অনেক সময় বিদেশিরা নাক গলাচ্ছেন। বিষয়টি নতুন কিছু নয়। একদিকে আমরা নিজেরা তাদের কথা বলার সুযোগ দিচ্ছি আবার অন্যদিকে তারাও বিনিয়োগের পরিবেশ নিশ্চিত করার জন্যই অভ্যন্তরীণ বিষয়ে আগ্রহ দেখাচ্ছেন। আমাদের ভূখণ্ডের অধিকাংশ রাষ্ট্রেই গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত হয়নি বলে বিদেশিরা আমাদের নির্বাচনব্যবস্থা কিংবা রাজনৈতিক পরিবেশ পর্যবেক্ষণ করেন। এভাবে তারা বিনিয়োগের আদর্শ পরিবেশ সম্পর্কে ধারণা নেন। কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমরাই তাদের কথা বলার সুযোগ করে দিই এবং এ নিয়ে দেশে বিরূপ প্রতিক্রিয়াও তৈরি হয়। এসব দিক বাদে কূটনৈতিক অঙ্গনে বাংলাদেশ প্রশংসনীয় সাফল্য দেখিয়েছে।
কূটনৈতিক তৎপরতায় বাংলাদেশ কোনোমতেই পিছিয়ে নেই। বরং বলা যায়, বৈদেশিক নীতির ক্ষেত্রে নীতিনির্ধারকরা যথেষ্ট আন্তরিকতা ও সদিচ্ছার পরিচয় দিচ্ছেন। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে কূটনীতি। আধুনিক বিশ্বে একটি জাতি বিনির্মাণ, একটি রাষ্ট্র সৃষ্টি ও বিকাশের পেছনে রয়েছে কূটনীতির অসাধারণ ভূমিকা। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল প্রতিষ্ঠিত ঐতিহাসিক মুজিবনগর সরকার বাংলাদেশের মুক্তি ও স্বাধীনতার প্রশ্নে বিশ্বব্যাপী ব্যাপক কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর কূটনৈতিক চিন্তাধারাই স্বাধীন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের মূলভিত্তি রচনা করেছে। বলা বাহুল্য, অল্প সময়ের শাসনামলে বঙ্গবন্ধুকে অসংখ্য কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়েছে এবং সেখানেও তিনি ব্যাপক সফলতা অর্জন করেছিলেন। এক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু বরাবরই জাতিগত আত্মমর্যাদাকে রেখেছেন সর্বাগ্রে। কূটনৈতিক তৎপরতায় ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়’- এই মূলমন্ত্রে উজ্জিবীত ছিলেন সারাজীবন এবং এখনও আমরা কূটনৈতিক অঙ্গনে এই মন্ত্রেই এগিয়ে চলেছি। আমাদের সঙ্গে কোনো কোনো রাষ্ট্রের সমস্যা ও বিরোধ রয়েছে। কিন্তু তাদের সঙ্গেও আমাদের কূটনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে। উন্নত রাষ্ট্রের নেতাদের কূটনৈতিক পর্যায়ে এত ভাবতে হয় না। সেজন্য আলাদা বিভাগ রয়েছে এবং তারা বিদেশ সফরের ক্ষেত্রে কৌশল অবলম্বন করে। কিন্তু আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে নানা প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। তারপরও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিষয়টি নিয়ে সবসময় ভাবেন। নিকট অতীতে এলডিসি সম্মেলন শেষ হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সফর করেছেন। বিদেশ সফরে তার সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশের দ্বিপক্ষীয় বৈঠকও হয়েছে। নেতৃত্বদানকারী পর্যায়ে বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গেই নেওয়া হয়, তাই কূটনীতিকরাও এ বিষয়ে যথেষ্ট তৎপর থাকেন।
একটি রাষ্ট্রের কূটনৈতিক তৎপরতার সঙ্গে রাষ্ট্রের নিজস্ব স্বার্থ জড়িত থাকে। ব্যবসার বিস্তার তার মধ্যে অন্যতম। বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের ক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ পরিবেশ নিশ্চিত করবে সরকার। ব্যবসায়ীরা হবেন এর সহযোগী শক্তি। অন্যদিকে কূটনীতিকরা প্রশাসনিক পর্যায়ে কাজ করবেন এবং প্রক্রিয়াকরণের ক্ষেত্রে পদক্ষেপ নেবেন। আমাদের কূটনীতিকরা এ বিষয়ে তৎপর নন তা বলা যাবে না। তবে আমি মনে করি, এই তা আরও বাড়ানো প্রয়োজন। চলমান বিশ্বে আস্তেধীরে কিছু করার সুযোগ নেই। বিদ্যমান সংকটে ক্ষমতা ও অর্থনীতির ক্রমেই পালাবদল ঘটছে। এ সময় দরকষাকষির জায়গা যেমন তৈরি হচ্ছে তেমনি বাণিজ্য প্রসারেরও নতুন সুযোগ তৈরি হচ্ছে। কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না, বাংলাদেশের মতোই অনেক উদীয়মান অর্থনীতি পরস্পরবিরুদ্ধ দুই শক্তির সঙ্গেই সদ্ভাব বজায় রাখতে পারছে। বিশ্ব কূটনীতিতে একদিকে ভারসাম্য বজায় রাখা এবং অন্যদিকে স্বকীয় সত্তা ধরে রাখার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সফলতা দেখাচ্ছে কিন্তু সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নিয়ে তা দ্রুত বাস্তবায়ন করতে না পারলে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়তে হবে। কূটনৈতিক অঙ্গনেও প্রতিযোগিতা তৈরি হয়েছে। এই প্রতিযোগিতার ধরন বোঝার দায়িত্ব কূটনীতিকের। একজন কূটনীতিককে তার ভূমিকা সম্পর্কে সঠিক ধারণা রাখতে হবে এবং কৌশলগত দিক থেকেও চৌকস হয়ে উঠতে হবে। যদি তা সম্ভব হয় তাহলে বিজনেস সামিটে যে আশাবাদের কথা শোনা গেছে তা বাস্তবিক রূপ পাবে। সৌদি আরব দেশে বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগের আগ্রহ দেখিয়েছে। সৌদি আরবের সঙ্গে আমাদের কূটনৈতিক সম্পর্কের বিষয়টি নানাদিক থেকে অর্থবহ। ইতোমধ্যে তারা বেশ কয়েকটি সাহসী পদক্ষেপ নিয়েছে এবং তাদের সহযোগিতা আমাদের বাণিজ্যের প্রসারে অনেক সাহায্য করবে তা নিশ্চিত। কিন্তু দেশে আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রতার ফলে অনেক ক্ষেত্রেই আমরা পিছিয়ে পড়ি। আমাদের এখানে প্রধান বাধা হলো, ভূমি অধিগ্রহণের বিভিন্ন জটিলতা এবং আমলাদের মানসিকতা। তাছাড়া বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মধ্যে আন্তঃযোগাযোগের অভাব থাকায় সমন্বয় হয় না। আর সমন্বয় হয় না বলেই অনেক সময় আমলাতান্ত্রিক জটিলতা বাড়তে থাকে। এই দীর্ঘসূত্রতার কারণে নানা সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। তবে এমন পরিস্থিতিতেও একজন কূটনীতিককে দক্ষতার পরিচয় দিতে হবে এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর মধ্যে সমন্বয় স্থাপন করার ব্যাপারে উদ্যোগী হতে হবে। যেকোনো কাজের তৎপরতার গতিবৃদ্ধিই পারে যেকোনো উদ্যোগ সফল করতে।
আমাদের কূটনৈতিক ক্ষেত্রে নানা প্রতিবন্ধকতা থাকার পেছনে একটি বড় কারণ রাষ্ট্র, প্রতিষ্ঠান এবং শিক্ষার সমন্বয় সাধন না করা। উন্নত বিশ্বে কূটনৈতিক বিষয়াদির চুলচেরা বিশ্লেষণ ও গবেষণার কাজ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো করে। এমনকি রাষ্ট্রের অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েও বিশ্ববিদ্যালয় বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। আমাদের দেশেও অনেক ক্ষেত্রে এমন কিছু হয়েছে বটে কিন্তু এর পুরোপুরি সমন্বয় সাধন নিশ্চিত হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে গবেষণা হলেও তা কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ থেকে যায়। গবেষক যদি বাস্তব প্রেক্ষাপটে তার গবেষণা প্রয়োগ করতে না পারেন তাহলে শেষ পর্যন্ত কাজের কাজ কিছু হয় না। শিক্ষার সঙ্গে রাষ্ট্র ও প্রতিষ্ঠানের সমন্বয় করতে পারলে তরুণ শ্রমশক্তি ও মেধাকেও কাজে লাগানো সম্ভব হবে। বিজনেস সামিট আমাদের সক্ষমতা ও সম্ভাবনারও ইঙ্গিত দিয়েছে। সেই সম্ভাবনা সামনে রেখেই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। কূটনৈতিক পর্যায়ে কার্যক্রম আরও গতিশীল করে তুলতে হবে। এখনও আমরা ভালো কাজ করছি কিন্তু ক্রমপরিবর্তনশীল বিশ্বে আরও গতিশীল না হতে পারলে আমাদের কিছু ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়তে হবে। আমাদের লক্ষ্য টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করা। এই দৃষ্টিকোণ থেকে বিদেশি বিনিয়োগের পথ সুগম করতে কূটনীতিকদের বিশেষ ভূমিকা রাখতে হবে।
– ড. দেলোয়ার হোসেন: অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; প্রেষণে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের (পিএসসি) সদস্য হিসেবে নিয়োজিত।
প্রকাশিত প্রতিদিনের বাংলাদেশ [লিংক]