২০২২ সাল শুরু হয়েছিল কোভিড-উত্তর বিশ্বের স্বপ্ন নিয়ে, যেখানে দেশগুলো করোনার ভয়াবহতা থেকে বের হয়ে আসার আশা করছিল। ভ্যাকসিন আবিষ্কার থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপের মাধ্যমে বিশ্ব একটি সুশৃঙ্খল অবস্থায় ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল।
বস্তুত, কোভিড-পরবর্তী আন্তর্জাতিক অর্থনীতি এবং সামাজিক সহযোগিতার মাধ্যমে সমগ্র বিশ্বকে করোনার ভয়াবহতাকে পেছনে ফেলে একটি ইতিবাচক অবস্থানে নিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়। কিন্তু ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক আক্রমণের ফলে বিশ্ব একটি বড় ধরনের সংকটের মুখোমুখি হয়। বিশ্ব ২০২২ সালের শুরু থেকেই রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে এক মহাসংকটে পতিত হয়। সব মিলে ২০২২ সালকে বলা যায় মহাসংকটের বছর। সম্ভবত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পৃথিবীতে বৈশ্বিকভাবে এত ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর কোরিয়া যুদ্ধ হয়েছে, ভিয়েতনাম যুদ্ধ হয়েছে এবং বিভিন্ন অঞ্চলে গৃহযুদ্ধ এবং নানা ধরনের সামরিক সংঘাত ও উগ্রবাদ আমরা দেখেছি। পাশাপাশি অর্থনৈতিক সংকটও আমরা দেখেছি। বিশেষ করে স্নায়ুযুদ্ধকালীন দুই পরাশক্তির মধ্যে যে উত্তেজনা ও বৈরিতা ছিল, সেটাকে বর্তমান সময়ের সংকটের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পৃথিবী কখনোই এতটা ভয়াবহতা প্রত্যক্ষ করেনি। ইউক্রেন যুদ্ধের পক্ষ হিসাবে আমরা যদি রাশিয়ার বিপরীতে পশ্চিমা বিশ্বকে দেখি, তাহলে নিঃসন্দেহে বলা যায়, এ যুদ্ধ একটি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের মতোই ঘটনা। কারণ পশ্চিমা বিশ্ব ব্যাপক শক্তি দিয়ে রাশিয়াকে মোকাবিলা করছে এবং সেখানে আমরা জি-সেভেন, ন্যাটো ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সরব ভূমিকা দেখতে পাই। ফলে দেখা যাচ্ছে, ঐক্যবদ্ধ পশ্চিমা বিশ্বের বিপরীতে রাশিয়া একটি পক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে রাশিয়া তার সামরিক শক্তি পূর্ণমাত্রায় ব্যবহার করছে। একইভাবে পশ্চিমা শক্তি রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউক্রেনকে ব্যাপকভাবে সামরিক সাহায্য দিচ্ছে। এ বাস্তবতায় ইউক্রেন যুদ্ধ চলছে এবং ২০২২ সালের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত নজিরবিহীনভাবে সমগ্র বিশ্বকে প্রভাবিত করছে।
এ যুদ্ধের কারণে বিশ্বে অনেক ধরনের নতুন প্রবণতা আমরা লক্ষ করছি। একদিকে নতুন করে অস্ত্রের প্রতিযোগিতা, সামরিকীকরণ, অন্যদিকে অর্থনৈতিক সংকট। ফলে বিশ্বের বৃহৎ রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা, অবিশ্বাস ও অসহযোগিতা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্বে নতুন মেরুকরণ তৈরি করছে। এই মেরুকরণের একদিকে রাশিয়া ও চীন, অন্যদিকে পশ্চিমা বিশ্ব। তবে নিরাপত্তার জন্য শুধু পশ্চিমা বিশ্ব বা রাশিয়া নয়, বরং সমগ্র বিশ্ব সামরিকীকরণের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। এছাড়া অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এ যুদ্ধ একটি ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে, বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য। অর্থনৈতিক সংকটের অগ্রভাগে রয়েছে জ্বালানি সংকট, খাদ্য সংকট, মূল্যবৃদ্ধি, মুদ্রাস্ফীতি এবং সাপ্লাই চেইন প্রায় ভেঙে পড়া। ২০২২ সালে আমরা দেখতে পেয়েছি, অর্থনীতির সূচকগুলো ক্রমান্বয়ে নিুগামী হয়েছে।
গত বছর আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে দ্বিতীয় যে বিষয়টি ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে, তা হলো তাইওয়ান সংকট। তাইওয়ানের পরিস্থিতি কখনোই সম্পূর্ণভাবে শান্ত ছিল না। অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মতো এ সংকট মাঝেমাঝেই অস্থিরতা তৈরি করেছে। বিভিন্ন সময়ে তাইওয়ান সংকট মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। তাইওয়ানকে কেন্দ্র করে গত বছর চীন ও যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন ও তাইওয়ানের মধ্যে নজিরবিহীন সামরিক শক্তি প্রদর্শিত হয়েছে। মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসির তাইওয়ান সফর গত বছরের একটি অন্যতম ঘটনা। কারণ এটি শুধু তাইওয়ান ও চীনের সম্পর্কের ওপর নয়, বরং যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের সম্পর্কের ওপরও বড় ধরনের প্রভাব ফেলেছে। এছাড়া তাইওয়ানকে মার্কিন সামরিক সহযোগিতা বৃদ্ধির একটি প্রবণতা আমরা দেখতে পাই, যেখানে দক্ষিণ চীন সাগর ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভূমিকা পরিলক্ষিত হয়েছে।
গত বছরের তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হচ্ছে করোনার ভয়াবহতা থেকে বেরিয়ে আসার প্রবণতা। যদিও এটি এখন পর্যন্ত চলমান, তবে আমরা দেখতে পাচ্ছি বিভিন্ন দেশ ভ্যাকসিনের ব্যবহারের ক্ষেত্রে এগিয়ে যাচ্ছে এবং করোনাকে সব দিক থেকে মোকাবিলার চেষ্টা করছে। যুদ্ধ এবং অর্থনৈতিক সংকটের পাশাপাশি অন্য সমস্যা থাকার পরও বিভিন্ন রাষ্ট্র করোনার ভয়াবহতা থেকে বের হয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার চেষ্টা করছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে মানুষের স্বাভাবিক পদচারণা শুরু হয়েছে। তবে গত বছরের শেষদিকে চীনে আবার করোনার সংক্রমণ বেড়েছে।
জলবায়ুর পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ বছর ছিল ২০২২ সাল। জলবায়ু পরিবর্তন রোধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে মিসরে কপ-২৭ অনুষ্ঠিত হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় কয়লাসহ জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমিয়ে আনার প্রতিশ্রুতিতে সম্মত হয় অংশগ্রহণকারী দেশগুলো। এ ছাড়া বৈশ্বিক গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রাখতে কার্বন নিঃসরণ কমিয়ে আনার জন্য পদক্ষেপ নেওয়ার কথা জানায় ধনী দেশগুলো। ২০১৫ সালে ঐতিহাসিক প্যারিস চুক্তিতে দেশগুলো তাপমাত্রা কমানোর যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, সেই চুক্তির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের ওপরও গুরুত্বারোপ করা হয়। তবে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ব্যাপারে তহবিল গঠনের বিষয়টি অমীমাংসিতই রয়ে গেছে।
২০২২ সালে শীর্ষ পর্যায়ের বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। জি-২০, জি-৭, বিমসটেক, আসিয়ান এবং অন্যান্য আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলোর মধ্যে বহুপাক্ষিক বৈঠকের আয়োজন করা হয়। অন্যদিকে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ ও নিরাপত্তা পরিষদে বিভিন্ন বিষয়ে ধারাবাহিক বিতর্ক ও আলোচনা হয়েছে। ফলে বহুপাক্ষিকতার জায়গা থেকে বিবেচনা করলে ২০২২ সাল একটি উল্লেখযোগ্য বছর হিসাবে বিবেচিত হবে, কারণ দেশগুলো পারস্পরিক যোগাযোগের জায়গায় ফিরে আসার চেষ্টা করেছে।
২০২২ সালের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো ইরানে নারীদের প্রতিবাদ আন্দোলন। এ আন্দোলনের ফলে শেষ পর্যন্ত ইরান সরকার বাধ্য হয়েছে ধর্মীয় পুলিশ প্রত্যাহারে। যদিও এ আন্দোলন নিয়ে বিতর্ক রয়েছে, তবে নিঃসন্দেহে বলা যায়, ইরানের ইতিহাসে, বিশেষ করে ১৯৭৯ সালের পর সর্বপ্রথম এ ধরনের একটি প্রতিরোধ ইরানের সরকারকে মোকাবিলা করতে হচ্ছে। নিঃসন্দেহে এ ঘটনা সম্পূর্ণ মধ্যপ্রাচ্যের সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে একটি নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
গত বছর রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে বড় ধরনের কোনো ঘটনা না ঘটলেও এ সংকট মোকাবিলার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের কূটনৈতিক তৎপরতার কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায়। রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশ বিশ্বের অনেক দেশের কাছ থেকে আরও বেশি সহযোগিতা ও সমর্থন অর্জন করতে পেরেছে। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে নির্যাতনকে গণহত্যা হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়ার পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের সেদেশে নেওয়ার কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশের জন্য আরেকটি বড় অর্জন হচ্ছে ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের সাময়িকভাবে স্থানান্তর করা। বাংলাদেশের অনেক বন্ধুরাষ্ট্র ও সংস্থা এ নিয়ে বিতর্ক করলেও শেষ পর্যন্ত তারা এর প্রশংসা করেছে এবং এর গুরুত্ব অনুধাবন করতে পেরেছে; তারা এখন এ নিয়ে ব্যাপকভাবে আশাবাদী। এছাড়া ৭৪ বছরের ইতিহাসে এই প্রথম জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে একটি প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়েছে। এ প্রস্তাবে মিয়ানমারের চলমান রাজনৈতিক সংকট এবং জান্তা সরকারের নির্মমতা আর রোহিঙ্গা সংকটের সমাধানের কথা বলা হয়েছে। সুতরাং বলা যায়, এটি বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক সাফল্য।
গত বছরের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হচ্ছে কাতারে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপ ফুটবল। শুরু থেকেই এই আয়োজনকে ঘিরে বিতর্ক তৈরি হয়। বিশেষ করে কাতারের শ্রম আইন এবং বিশ্বকাপ আয়োজনের জন্য অবকাঠামো নির্মাণে কাজ করা শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে পশ্চিমা বিশ্ব সোচ্চার ছিল। এক্ষেত্রে কাতারকে আয়োজক দেশ হিসাবে তুচ্ছ করার প্রয়াস লক্ষ করা গেছে। তবে ফিফার প্রেসিডেন্ট নিজেই এর উত্তম জবাব দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, যেসব অভিযোগ কাতারের বিরুদ্ধে উপস্থাপন করা হয়েছে, সেসব অভিযোগ ভিত্তিহীন এবং এ অভিযোগ করার আগে পশ্চিমা বিশ্বের উচিত তাদের তিন হাজার বছরের ভূমিকার জন্য ক্ষমা চাওয়া। কারণ অতীতের দিকে ফিরে তাকালে আমরা দেখতে পাই তাদের তিন হাজার বছরের শোষণের ইতিহাস। এ ধরনের বিতর্ককে পেছনে ফেলে কাতার বিশ্বকাপ ইতিহাসের অন্যতম সেরা আয়োজন হিসাবে বিবেচিত হয়েছে এবং এটি সর্বজনীনভাবে স্বীকৃত হয়েছে। বিশ্বকাপ ফুটবলের মাধ্যমে মানুষের মধ্যে এক ধরনের প্রাণের সঞ্চার ও সংহতি সৃষ্টি হয়েছিল। প্রায় এক মাস সারা পৃথিবীর মানুষ মন্ত্রমুগ্ধের মতো বিশ্বকাপ ফুটবলের উন্মাদনা এবং শৈল্পিক খেলা উপভোগ করেছে। এটি এই সংকটপূর্ণ সময়ে সারা বিশ্বের মানুষের জন্য একটি বড় পাওয়া।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে ২০২২ সাল নিঃসন্দেহে একটি গুরুত্বপূর্ণ ও সফল বছর হিসাবে বিবেচিত হবে। গত বছর বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কূটনীতির ক্ষেত্রে একটি মাইলফলক রচিত হয়েছে। বাংলাদেশ নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত পদ্মা সেতুর উদ্বোধন করেছে। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ পৃথিবীর সামনে একটি অনন্য নজির স্থাপন করেছে। এর পেছনে রয়েছে দেশের অনন্যসাধারণ কূটনৈতিক সক্ষমতা, নেতৃত্ব, শক্ত মনোবল ও অর্থনৈতিক কূটনীতির সফল চর্চা। কারণ বিশ্বব্যাংক এবং অন্যান্য দাতা সংস্থার অর্থায়ন প্রত্যাখ্যান করে বাংলাদেশ তার নিজের অর্থে আত্মমর্যাদাকে অক্ষুণ্ন রেখে যে একটি বিশাল অবকাঠামো তৈরি করেছে, তা নিঃসন্দেহে এদেশের কূটনীতির একটি বড় সাফল্য। পাশাপাশি অন্য মেগা প্রজেক্টগুলোর কয়েকটিও সমাপ্ত করেছে। চীনের সহায়তায় কর্ণফুলী টানেল এবং জাপানের সহায়তায় ঢাকার মেট্রোরেল এর অন্যতম। নগর সভ্যতা ও আধুনিক সভ্যতার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং এর আধুনিকতম সংস্করণ হচ্ছে মেট্রোরেল, যা আংশিক সম্পন্ন করে বাংলাদেশ একটি নতুন দিগন্তে প্রবেশ করেছে।
২০২২ সালের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রাপ্তি হচ্ছে জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলে এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে সর্বোচ্চ ভোটে ২০২৩-২০২৫ মেয়াদের জন্য বাংলাদেশের সদস্য নির্বাচিত হওয়া। গত বছরও বাংলাদেশ ভারসাম্যপূর্ণ ও জোটনিরপেক্ষতার কূটনীতি অব্যাহত রাখে এবং এর মাধ্যমে ভারত ও চীনসহ শক্তিশালী সব দেশের সঙ্গে একটি সুসম্পর্ক বজায় রাখছে। এর ফলে বাংলাদেশের উন্নয়ন, নিরাপত্তা ও প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত হচ্ছে।
গত বছরের আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, নতুন বছরেও অধিকাংশ ঘটনা চলমান থাকবে। কারণ ইউক্রেন যুদ্ধের শেষ হওয়ার কোনো লক্ষণ দৃশ্যমান নয়। তাইওয়ান সংকট সমাধানের কোনো লক্ষণ নেই। ২০২৩ সালে বৃহৎ শক্তিগুলোর মধ্যকার যে প্রতিযোগিতা, প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও বৈরিতা, তা আরও বৃদ্ধি পেতে পারে। নতুন করে একটি স্নায়ুযুদ্ধ শুরু হওয়ার যে প্রবণতা, সেটির ভিত্তি ২০২২ সালে তৈরি হয়েছে এবং ২০২৩ সালে আমরা বলতে পারি স্নায়ুযুদ্ধ নতুন মাত্রা পেতে যাচ্ছে।
অন্যদিকে, যেহেতু বিশ্ব পূর্ণাঙ্গভাবে একটি বহুমেরুকেন্দ্রিক বাস্তবতায় প্রবেশ করেছে, সেহেতু বৈশ্বিক যে ঘটনাগুলো মানুষ ও রাষ্ট্রগুলোকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে, সেখান থেকে বের হয়ে আসার চেষ্টা ২০২৩ সালে চলমান থাকবে। এর অংশ হিসাবে ইউক্রেন যুদ্ধ সমাপ্ত করার জন্য পশ্চিমা বিশ্ব ও রাশিয়ার মধ্যে শান্তি আলোচনা অথবা যুদ্ধবিরতির প্রচেষ্টা শুরু হতে পারে। একইসঙ্গে অনেক দেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক, বিশেষ করে ভারত ও চীনের মধ্যকার বৈরিতা ও প্রতিযোগিতা কিছুটা হ্রাস পেতে পারে এবং সীমিত সহযোগিতামূলক পরিবেশ তৈরি হতে পারে। কারণ ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে ভারতের যে প্রতিক্রিয়া, তা নিঃসন্দেহে পশ্চিমা দেশগুলোর মনঃপূত হয়নি। ভারত একটি স্বাধীন অবস্থান বজায় রাখার চেষ্টা করছে এবং তা চীনের সঙ্গে তার সম্পর্কের উন্নতির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হিসাবে কাজ করতে পারে।
তবে যে বিষয়টি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তা হলো, ২০২৩ সালে ভূ-রাজনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন। ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল, চীনের যোগাযোগ ও অর্থনৈতিক শক্তি প্রদর্শন নীতি নতুন করে চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে পশ্চিমা বিশ্বের দূরত্ব আরও বৃদ্ধি করতে পারে। ফলে ২০২৩ সালেও বিশ্ব একটি সামরিক উত্তেজনা, অস্ত্র প্রতিযোগিতা, মেরুকরণ ও অনিশ্চয়তার মুখোমুখি হতে পারে।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রে জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে অভ্যন্তরীণ রাজনীতির ওপর চাপ থাকবে। তারপরও বাংলাদেশ পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে যে ধরনের কৌশল অবলম্বন করছে, তা বজায় থাকবে। বাংলাদেশ তার জোটনিরপেক্ষতা এবং স্বকীয় নীতি অনুসরণ করবে এবং কোনো বৃহৎ শক্তির চাপ প্রয়োগের নীতির ক্ষেত্রেও আত্মমর্যাদা বজায় রাখবে। অন্যদিকে অর্থনৈতিক কূটনীতির প্রসার, রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলা এবং জলবায়ু বিষয়ে নিজ অবস্থান অব্যাহত রাখবে। পাশাপাশি মেগা প্রজেক্টগুলো সম্পন্ন করাসহ যেসব লক্ষ্য বাংলাদেশ নির্ধারণ করেছে, বিশেষ করে ২০২৬ সালে উন্নয়নশীল রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার এবং ২০৪১ সালে উন্নত ও স্মার্ট বাংলাদেশের যে স্বপ্ন দেখছে, তা সামনে রেখে পররাষ্ট্রনীতি পরিচালনা করবে।
– ড. দেলোয়ার হোসেন: অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; প্রেষণে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের (পিএসসি) সদস্য হিসেবে নিয়োজিত।
যুগান্তরে প্রকাশিত [লিংক]