সম্প্রতি আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিদেশি কূটনীতিকদের নাক গলানো বেড়েছে, যার পরিপ্রেক্ষিতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। তারা বলেছেন, ‘আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিদেশিদের মাতব্বরির দরকার নেই।’ অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিদেশিদের হস্তক্ষেপ কিংবা যুক্ত হওয়ার বিষয়টি অত্যন্ত পুরোনো। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক কিংবা বিশ্বরাজনীতির দিকে মুখ ফেরালেই দেখতে পাই, বিশেষত স্নায়ুযুদ্ধের সময় এ ধরনের তৎপরতা ছিল এবং নানা দিক থেকে হস্তক্ষেপ ছিল। স্নায়ুযুদ্ধ শেষ হওয়ার পরও, বিশেষত উন্নয়নশীল বিশ্বের অনেক দেশেই পশ্চিমা কূটনীতিকরা তাদের বক্তব্য কিংবা কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে হস্তক্ষেপের চেষ্টা করেন- এমনটাও আমরা দেখেছি। যদিও প্রায় সব দেশেই বিদেশিরা এ ধরনের তৎপরতা চালালেও সবখানে তারা সফল হতে পারেন না। বাংলাদেশেও সেই ধারাবাহিকতায় বিশ্বরাজনীতির এই নেতিবাচক প্রবণতা ছিল, যা কখনই গ্রহণযোগ্য নয়। আন্তর্জাতিক রাজনীতির এবং দ্বিমেরুকেন্দ্রিক বিশ্ববাস্তবতার কারণে এমনটি ঘটেছে এবং এখনও এ ধরনের হস্তক্ষেপের বিষয় সামনে আসছে। অর্থাৎ বিষয়টি আমাদের জন্য নতুন নয় এবং অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, দেশের জন্য এমনটি সুফল বয়ে আনতে পারে না। কারণ বিদেশি হস্তক্ষেপের কারণে অতীতে দেশের রাজনীতিতে ক্ষতিকর প্রভাব পড়েছে। ফলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর প্রতিক্রিয়া স্বাভাবিক। কারণ অতীতেও আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিদেশি কূটনীতিকদের হস্তক্ষেপের প্রয়োজন ছিল না এবং এখনও নেই।
সম্প্রতি সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনগুলোতে বলা হচ্ছে, বাংলাদেশের প্রতি বাইডেন প্রশাসনের আগ্রহ বেড়েছে। দেশের প্রতি বাইডেন প্রশাসনের এই আগ্রহকে অনেকেই ভূরাজনৈতিক স্বার্থের অন্যতম ইস্যু হিসেবে আখ্যায়িত করছেন। বিষয়টি কি আদৌ তাই? বাংলাদেশের গুরুত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে, এটি সত্যি। তবে এই গুরুত্ব দেশের মানুষ যতটা না উপলব্ধি করতে পারে, তার চেয়ে বেশি উপলব্ধি করে বিশ্বের অন্যান্য দেশ বিশেষত বৃহৎ শক্তিগুলো।
‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়’ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুখে উচ্চারিত আমাদের পররাষ্ট্রনীতির এই মূলমন্ত্রের কারণেই বৃহৎ শক্তিগুলোর সঙ্গে সামঞ্জস্য ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখা সম্ভব হচ্ছে। এর সঙ্গে আমাদের ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব বৃদ্ধির পেছনে যুক্ত হয়েছে অর্থনৈতিক উন্নয়ন। বিগত ১০ বছরে আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নকে ইতোমধ্যে অনেকেই উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। অথচ জনবহুল এই দেশটিকেই এক সময় ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলে হেয় করা হতো। এখন আমাদের মাথাপিছু আয়, প্রবৃদ্ধি ও জীবনযাত্রার মান বেড়েছে। তাই অর্থনৈতিক দিক থেকে বাংলাদেশের গুরুত্ব নিঃসন্দেহে বেড়েছে। তবে ভুলে গেলে চলবে না, ভৌগোলিক অবস্থান বিবেচনায়ও আমাদের ব্যাপক গুরুত্ব রয়েছে। বিশেষত চীন এবং ভারতের সামরিক উত্থানে বাংলাদেশের প্রতি বহির্বিশ্বের অনেক শক্তিরই আগ্রহ বেড়েছে। বাংলাদেশ বরাবরই তার পররাষ্ট্রনীতি অনুযায়ী নিজ দেশের সার্বভৌমত্ব এবং আত্মমর্যাদা অক্ষুণ্ন রেখে অন্য রাষ্ট্রের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ অংশীদারিত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে। সব দিক বিবেচনায় তাই বলা যায়, বাইডেন প্রশাসনের বাংলাদেশের প্রতি আগ্রহ খুবই স্বাভাবিক। শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নয়, অন্যান্য বৃহৎ শক্তিও বাংলাদেশের সঙ্গে নিজ নিজ সম্পর্ক জোরদার করার মাধ্যমে পারস্পরিক স্বার্থ উদ্ধারে আগ্রহ দেখাচ্ছে। আবার অনেক সময় কিছু শক্তি বাংলাদেশেরে এই গুরুত্ব কিছুটা অস্বীকার করে আমাদেরকে কোণঠাসা করারও চিন্তাভাবনা করে। তবে এটি যে ভুল নীতি, তা হয়তো তারা অনুধাবন করতে পারছে না। তাই ভবিষ্যতে ইউরোপ কিংবা উন্নত বিশ্বের বাইরে যেসব দেশ নিজস্ব অবস্থান গড়ে তুলতে পারবে তাদের মাঝে বাংলাদেশ অন্যতম। সেই পরিপ্রেক্ষিতেই হয়তো মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লুর ঢাকা সফরের পরিকল্পনা, যার মাধ্যমে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বাংলাদেশ-মার্কিন সম্পর্ককে একটি স্থায়ী অংশীদারিত্ব হিসেবে দেখতে চাচ্ছেন।
যেমনটা বলেছি, অনেক সময় বড় শক্তিগুলো আমাদের ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব অস্বীকারের চেষ্টা করে। দেশের রাজনৈতিক বিভাজনের সুযোগে তারা গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের কথা বলেন। সঙ্গত কারণে এই প্রশ্নও দাঁড় করাতে হয়, গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের জন্য এত হাঁকডাকের পরেও ইসরায়েলের প্রতি তাদের সমর্থন থাকে কীভাবে? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারের কথা প্রচার করে। অথচ বিশ্বের অন্য অনেক দেশের সঙ্গে এসব দেশের সম্পর্ক বিবেচনা করলে এক ধরনের বৈপরীত্যও দেখা যায়। একই বিষয় আমরা ইসরায়েলের ক্ষেত্রেও দেখি। বিশেষত ইসরায়েলের বর্তমান প্রেসিডেন্ট বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু যে ধরনের নিষ্ঠুরতা এবং আগ্রাসন চালাচ্ছেন প্যালেস্টাইনের বিরুদ্ধে তা এই রাষ্ট্রগুলোর স্ববিরোধিতাই স্পষ্ট করে।
আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে এসব বিষয় বিবেচনায় আনা যায় না। কারণ আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে জাতীয় স্বার্থরক্ষায় বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে দর-কষাকষির জায়গা তৈরি হয়। এক্ষেত্রে মানবাধিকার এবং গণতন্ত্রের কথা বলা মূলত ওই দর-কষাকষির জায়গা করার জন্যই। সে জন্য বাংলাদেশের সঙ্গে যতটা গুরুত্ব দিয়ে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার বিষয়ে কথা বলা হয়, অন্য দেশের সঙ্গে আবার অত গুরুত্ব দিয়ে তা বলা হয় না। এও মনে রাখতে হবে, যেসব দেশ অ্যালায়েন্স কিংবা জোটের অধীন, সেসব দেশের ক্ষেত্রে কিছু কিছু বিষয় এড়িয়ে যাওয়া হয়। বর্তমান বিশ্বে এমন অনেক উদাহরণ রয়েছে। মানবাধিকার, গণতন্ত্র, পরিবেশের মতো বিষয়গুলোও আন্তর্জাতিক রাজনীতির অংশ। শক্তিশালী দেশগুলো তাদের কূটনীতিতে এসব বিষয় অন্তর্ভুক্ত করে। এক্ষেত্রে প্রতিটি রাষ্ট্রই নিজেদের কৌশলগত এবং অর্থনৈতিক স্বার্থকেই প্রাধান্য দেয় এবং তা নিশ্চিত করার চেষ্টা চালায়।
অভিযোগ আছে, আমাদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বিদেশিদের হস্তক্ষেপের জন্য বিরোধীদের ভূমিকা রয়েছে। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির ভেতর থাকা অস্থিরতা এবং অবিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে বিদেশি কূটনীতিকরা নানা তৎপরতা চালান- এমন অভিযোগও আছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, ভারতসহ বিশ্বের আরও অনেক দেশেই রাজনৈতিক বিভাজন রয়েছে। পশ্চিমা উন্নত সংস্কৃতির দেশগুলোতেও বড় ধরনের বিভাজন ক্রমেই দৃশ্যমান হচ্ছে। কিন্তু এই বিভাজনকে কাজে লাগিয়ে ওইসব দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে অন্যান্য দেশকে সেই অর্থে অবস্থান নিতে দেখা যায় না। রাজনৈতিক বিভাজন প্রতিটি দেশের জন্যই বাস্তবতা। আমাদের রাজনীতিতেও বিভাজন ছিল এবং এখনও আছে। এই বিভাজনকে দেশের রাজনৈতিক প্রক্রিয়া অনুসারেই মোকাবিলা করার কথা এবং তেমনটিই হয়ে থাকে। যেসব দল মনে করে তাদের যথেষ্ট রাজনৈতিক শক্তি অথবা জনসমর্থন নেই তারাই অনেক সময় বিদেশি কূটনীতিকদের কাছে সাহায্য চায়। আর সে সুযোগ নিয়েই বিদেশি কূটনীতিকরা আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করেন। আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিদেশিদের হস্তক্ষেপের জন্য রাজনৈতিক বিভাজন অনেকাংশে দায়ী হলেও আমাদের রাজনীতির দুর্বলতা এবং নেতৃত্বের অভাবই এক্ষেত্রে বেশি দায়ী। যেকোনো দেশেরই রাজনৈতিক ব্যবস্থা বা প্রক্রিয়ার দুর্বলতা থেকে বিদেশিরা হস্তক্ষেপের সুযোগ সন্ধান করেন। বর্তমানে যা দেখা যাচ্ছে তা মূলত আমাদের এই রাজনৈতিক দুর্বলতারই ফল।
বিশ্বব্যবস্থার মূল হচ্ছে রাষ্ট্র। প্রতিটি রাষ্ট্রই স্বাধীন ও সার্বভৌম এবং তাদের নিজস্ব ইতিহাস ও সংস্কৃতি রয়েছে। সেদিক থেকে আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং আত্মমর্যাদাও কম নয়। আমরা এমন এক জাতি, যারা নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে দেশকে স্বাধীন করেছি। শুধু তাই নয়, মুক্তিযুদ্ধকালীন আমাদের বিপক্ষে থাকা প্রবল আন্তর্জাতিক বিরোধকেও আমরা মোকাবিলা করেছি। এমন একটি দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিদেশিরা হস্তক্ষেপ করবেন কিংবা কোনো সমস্যা সমাধানে বিদেশি পক্ষকে ব্যবহার করার বিষয়টি দুঃখজনকই বলতে হবে। স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে এমনটি কখনই গ্রহণযোগ্য নয়। এমনকি আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা স্মরণ করলেও এমন হস্তক্ষেপ মেনে নেওয়ার নয়। আমি মনে করি, আমাদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বিদেশিদের নাক গলানো কিংবা সমাধানকারী পক্ষ হিসেবে অবস্থান নেওয়ার বিষয়টি আমাদের রাজনীতির বড় দুর্বলতা। এই জায়গা থেকে বেরুতে হলে আমাদের নিজেদের সমস্যা নিজেদেরকেই সমাধান করতে হবে। রাজনীতি মানেই মতপার্থক্য থাকবে। তবে এই মতপার্থক্য থাকায় দেশে নিজেদের ভেতর যে ধরনের সমস্যা তৈরি হয়, তা নিজেদেরই সমাধান করতে হবে। এও উপলব্ধি করতে হবে, আমাদের অভ্যন্তরীণ সমস্যা কোনোভাবেই অন্য কোনো দেশ বা পক্ষ সমাধান করতে পারবে না। ইতিহাস তেমনটিই সাক্ষ্য দেয়।
ভারত ১৯৫০ সাল থেকেই গণতন্ত্র চর্চা করছে। সেই গণতন্ত্র কিন্তু বিদেশিদের হাত ধরে ভারতে আসেনি। বাংলাদেশেও যে গণতন্ত্রের চর্চা আমাদের ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করেছে এবং চর্চিত হচ্ছে, তাও বিদেশিদের হাত ধরে আসেনি। এখানকার গণতন্ত্র এই দেশের মানুষের আন্তরিক প্রচেষ্টার মাধ্যমেই গড়ে ওঠা। কেউ যদি বিদেশি পক্ষের সহায়তায় ক্ষমতায় যাওয়ার চিন্তা করেন তা হবে শর্টকাট টানেলের মাধ্যমে তাদের রাজনৈতিক অভিলাষ পূরণের চেষ্টা। রাজনীতিকদের মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন প্রয়োজন। সহজ পথে ক্ষমতায় অধিষ্ঠানের চিন্তা থেকে সরে আসতে হবে। অন্যরা সুযোগ খুঁজবেই, সেই সুযোগের পথ বন্ধ করতে হবে। সঙ্গে দেশের মর্যাদা যেন ক্ষুণ্ন না হয়, সে বিষয়ে উপলব্ধি বাড়াতে হবে।
– ড. দেলোয়ার হোসেন: অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; প্রেষণে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের (পিএসসি) সদস্য হিসেবে নিয়োজিত।
প্রকাশিত প্রতিদিনের বাংলাদেশ [লিংক]