স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ বিশ্বসম্প্রদায়ের নজরে আসতে পারেনি সৃষ্ট নানা নেতিবাচকতার কারণে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন বিধ্বস্ত দেশটি গড়তে অক্লান্ত প্রয়াস চালান তখন এর বিপরীতে সক্রিয় হয়ে ওঠে দেশ বিরোধীরা। তারপর কেটে গেছে পাঁচ দশকেরও বেশি সময়। বিগত পাঁচ দশকে উন্নয়ন, গণতন্ত্র, অর্থনীতির বিভিন্ন খাত এবং ভূ-রাজনৈতিক অঙ্গনে বাংলাদেশ প্রভাবশালী রাষ্ট্রগুলোর কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশের ভৌগোলিক গুরুত্ব বেড়েছেÑ এ বিষয়ে ইতঃপূর্বেও প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এ লিখেছিলাম। আমাদের স্বাধীনতার ৫২তম বার্ষিকীতে অভিনন্দন বার্তা পাঠিয়েছে চীন, রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত। তাদের এই বার্তাগুলো বিদ্যমান বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। চীনের রাষ্ট্রপতি তার শুভেচ্ছাবার্তায় জানিয়েছেন, বাংলাদেশ-চীন দৃঢ় এবং গভীর রাজনৈতিক আস্থা উপভোগ করছে। অর্থনীতি ও কূটনীতিতে অসাধারণ সাফল্যের জন্য বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে প্রশংসিত হচ্ছে। বিশেষত মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি জে ব্লিনকেন তার শুভেচ্ছাবার্তায় যে ধরনের ভাষা ব্যবহার করেছেন তা বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি বলেছেন, ‘বাংলাদেশ দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতি, ক্রমবর্ধমান সুশিক্ষিত জনশক্তি এবং গতিশীল যুব জনসংখ্যার সঙ্গে ‘দ্রুত আঞ্চলিক নেতা হয়ে উঠছে।’ আগামী বছরে এই সম্পর্ক আরও দৃঢ়ীকরণের আশ্বাসও তিনি দিয়েছেন।
এশিয়ার ভৌগোলিক অংশের অন্য দেশগুলোর সঙ্গে তুলনা করলে বাংলাদেশের অবস্থান বোঝা সহজ হবে। বিশেষত, চীন ও ভারতের পর ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক গুরুত্বের বিবেচনায় বাংলাদেশের নাম আসবে সবার আগে। আমি বলব, বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিই এই সফলতার মূল চাবিকাঠি। মূলত বঙ্গোপসাগরীয় অঞ্চল শাসন ও দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কোন্নয়নের মাধ্যমে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে বাংলাদেশ ভৌগোলিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও আমাদের প্রতি বরাবরই আগ্রহ দেখিয়ে চলেছে।
আমাদের ভৌগোলিক অবস্থা্নের পাশাপাশি উন্নয়নের চিত্র দেখে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আরও সম্পর্কোন্নয়নের কথা ভাবছে। তাদের নিজেদের স্বার্থেই এই সম্পর্ক বহুমাত্রিক করার তোড়জোড় ইতোমধ্যে শুরু করেছে এবং তার প্রমাণ বিভিন্ন সফর ও শুভেচ্ছাবার্তার মাধ্যমে দেখা যাচ্ছে। এমন নয় যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আমাদের আগে কখনও শুভেচ্ছাবার্তা জানায়নি। কিন্তু এ বছরের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পাঠানো শুভেচ্ছাবার্তা কিছুটা ব্যতিক্রম। এই শুভেচ্ছাবার্তায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উচ্ছ্বাস চোখে পড়ার মতোই। আজ থেকে ১০ বছর আগেও আমরা এমন কিছু দেখতে পাইনি। অল্প সময়ে এই পরিবর্তন থেকে স্পষ্টতই বোঝা যায়, আঞ্চলিক পর্যায়ে বাংলাদেশের গুরুত্ব বেড়ে চলেছে। তারা যে বাংলাদেশের সম্ভাবনা খতিয়ে দেখছে এবং আমাদের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের মাধ্যমে কী কী স্বার্থ হাসিল করতে পারবে, তাও বিবেচনা করছে। এটি নিঃসন্দেহে একটি ইতিবাচক দিক দুই দেশের জন্যই।
এমনকি চীনের রাষ্ট্রপতি শি জিনপিংয়ের শুভেচ্ছাবার্তায়ও আন্তরিকতার ছাপ সুস্পষ্ট। স্বাধীনতা দিবসে বাংলাদেশের বন্ধুপ্রতিম প্রতিটি রাষ্ট্রই শুভেচ্ছা জানিয়েছে। কিন্তু এবার প্রভাবশালী রাষ্ট্রগুলোর উচ্ছ্বাস থেকে বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব কতটা তা আরও স্পষ্ট হয়েছে। বাংলাদেশ শুধু বর্তমান বিশ্ব বাস্তবতায় গুরুত্বপূর্ণই নয়, বরং ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের উদীয়মান শক্তি হিসেবেও গণ্য হচ্ছে। বাংলাদেশকে ঘিরে এই উচ্ছ্বাস একই সঙ্গে বাংলাদেশের সম্ভাবনা ও ভবিষ্যতে করণীয় পদক্ষেপের জন্য ইঙ্গিতবাহী। তবে ভুলে গেলে চলবে না, বিশ্ব রাজনীতিতে আমাদের অবস্থান শুধু সম্ভাবনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। আমরা ইতোমধ্যে অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প হাতে নিয়েছি। অনেক প্রকল্প সফলভাবে ইতোমধ্যে বাস্তবায়নও করা হয়েছে। এই যে গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প গ্রহন এবং বিভিন্ন বিষয়ে নিজেরাই সিদ্ধান্ত নেওয়াÑ এসবই আমাদের সক্ষমতার পরিচায়ক। নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে সফলতা পেয়েছে বলে বাংলাদেশ আজ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে সভাপতিত্ব করছে।
আমরা জানি, ইতোমধ্যে বাংলাদেশ জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদের এক্সিকিউটিভ মেম্বার নির্বাচিত হয়েছে। এমনকি জাতিসংঘের পানি সম্মেলনে বাংলাদেশ সহসভাপতিত্ব করেছে। যেকোনো আন্তর্জাতিক ফোরামেই বাংলাদেশের ভূমিকাকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। বাংলাদেশের সঙ্গে অধিকাংশ রাষ্ট্রই সম্পর্কোন্নয়নের চেষ্টা করছে। শুধু ভারত কিংবা চীনই নয়, অন্য অনেক রাষ্ট্রও আগ্রহ দেখাচ্ছে। কিছুদিন আগেই বাংলাদেশে ৪৫ বছর পর আবার দূতাবাস খুলেছে ম্যাক্সিকো। বাংলাদেশের প্রতি তাদের ব্যাপক আগ্রহ তৈরি হয়েছে বলেই তারা এমন উদ্যোগ নিয়েছে। আর্জেন্টিনার দূতাবাসের মাধ্যমে ব্রাজিল, ম্যাক্সিকো ও অন্যান্য ল্যাটিন রাষ্ট্রের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক বাড়ানোর সুযোগ তৈরি হচ্ছে। আসিয়ান সদস্যভুক্ত রাষ্ট্র, জাপানসহ অন্যান্য উন্নয়শীল দেশের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের সুযোগ থেকে একটি বিষয় সহজেই বোঝা যায়, বাংলাদেশের শক্তিমত্তা গড়ে উঠছে বৈশ্বিক পরিসরে। অন্যান্য রাষ্ট্রের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক বাড়লে বুঝতে হবে অন্য রাষ্ট্রও এই শক্তিমত্তাকে স্বীকার করে নিচ্ছে বলেই আগ্রহ দেখাচ্ছে।
আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে দ্বিপক্ষীয় এমনকি বহুমাত্রিক সম্পর্কের নানা হিসাব-নিকাশ কাজ করে। তা ছাড়া প্রভাবশালী রাষ্ট্রগুলোর মধ্যকার সম্পর্কের প্রকৃতি ও নানা স্বার্থের উপরও এই সম্পর্ক অনেকাংশে নির্ভর করে। আজ থেকে তিন বছর আগের প্রেক্ষাপটে দৃষ্টি দেওয়া যাক। বৃহৎ শক্তিগুলোর মধ্যে এত প্রতিদ্বন্দ্বিতা তখন ছিল না। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ধরন তখন যেমন ছিল তা বর্তমানের সঙ্গে মেলানো সম্ভব নয়। এখন অবস্থার দ্রুত পালাবদল ঘটছে। বর্তমানে রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে এক ধরনের বৈরিতা এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতা দেখা যাচ্ছে। অবস্থার প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্রকেও তার সিদ্ধান্ত ঘন ঘন পাল্টাতে হচ্ছে। সংবাদমাধ্যমে প্রায় প্রতিনিয়তই দেখা যায়, এক রাষ্ট্র অন্য রাষ্ট্রকে নানাভাবে দোষারোপ করছে। সম্প্রতি চীনা সংবাদমাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে একটি প্রতিবেদন ছাপানো হয়েছে। বিভিন্ন বিষয়ে এভাবেই বৃহৎ শক্তিগুলো একে অপরকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিচ্ছে। বৃহৎ শক্তিগুলোর মধ্যকার সম্পর্কের পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব নানাভাবে বাড়ছে। এই গুরুত্ব ধারণ করার মতো অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সক্ষমতাও আমাদের এতদিনে তৈরি হয়েছে। নিজ সক্ষমতার জায়গা থেকেই এমন পরিস্থিতির মোকাবিলা করা এবং যেকোনো সংকট নিরসনে অর্থবহ ভূমিকা পালন করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অগ্রগণ্য ভূমিকা রাখছে। শুধু তা-ই নয়, এই প্রথম বৈশ্বিক সংকট নিরসনে বাংলাদেশের ভূমিকা রাখার সুযোগ আমরা লক্ষ করছি। এর ফলে আন্তর্জাতিক আইনে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির শক্তি ক্রমেই স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান হচ্ছে।
বাংলাদেশকে নিয়ে সত্তর-আশির দশকে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে যে ধ্যান-ধারণা ছিল তা আজ অনেকাংশেই দূর হয়ে গেছে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে যে আন্তর্জাতিক, আঞ্চলিক হিসাব-নিকাশ তৈরি হচ্ছে এবং কূটনৈতিক বাতাবরণ তৈরি হয়েছে, তার মধ্যে বাংলাদেশ ভালো অবস্থানেই রয়েছে। এমনকি বাংলাদেশ তার বন্ধু রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সদ্ভাব বজায় রেখে উন্নয়ন, সংকট নিরসনসহ নিরাপত্তাজনিত অনেক বিষয়ে কাজ করে চলেছে। অনেকেই মনে করছেন চীন, যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে অনেক গুরুত্ব দিচ্ছে। কিন্তু আমি মনে করি, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনটি চীন কিংবা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বেশি গুরুত্বপূর্ণ নয়। অতীতেও দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিভিন্ন প্রভাবশালী দেশ নাক গলানোর চেষ্টা করেছে এবং এখনও নানাভাবে করছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমরাই তাদের এই সুযোগ করে দিচ্ছি। তবে বিষয়টি একেবারে নতুন কিছু নয়। আশা করা যায়, কূটনৈতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের যে ভূমিকা তা বিবেচনায় এই প্রবণতা কমতে পারে। যেসব দেশ ভূ-রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নিজেদের সক্ষমতার জায়গা গড়ে তুলতে পেরেছে, তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিদেশিরা নাক গলানোর সুযোগ পায় কম। বাংলাদেশেরও যেহেতু সক্ষমতার জায়গা তৈরি হয়েছে, তাই প্রভাবশালী রাষ্ট্রের চাপ আগামী জাতীয় নির্বাচনে নির্বাচনে প্রত্যক্ষ প্রভাব রাখবে বলে মনে করি না। দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিদেশিদের হস্তক্ষেপ একটি অপ্রয়োজনীয় কাজ। সচরাচর থাইল্যান্ড, মালেশিয়া, ভারত, ইন্দোনেশিয়ার মতো রাষ্ট্রের নির্বাচন নিয়ে এমন অনেক দেশ আছে যেখানে এত মাতামাতি দেখা যায় না। প্রতিটি দেশেই রাজনৈতিক পরিস্থিতি তার স্বাভাবিক গতিতে চলমান। বিদেশিরা তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলানোর অবকাশ পায় না। কারণ সেসব দেশের রাজনীতিকরা এ ব্যাপারে সজাগ।
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কারা অংশ নিচ্ছে এ নিয়ে চীন বা যুক্তরাষ্ট্র অত ভাবিত নয়। তারা মূলত যারা ক্ষমতায় আছে বা থাকবে তাদের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো রাখার বিষয়ে অধিক মনোযোগী। প্রভাবশালী রাষ্ট্রগুলো নিজেদের জাতীয় স্বার্থকেই প্রাধান্য দেয়। কী করলে তাদের নিজস্ব জাতীয় স্বার্থোদ্ধার হবে তা নিয়েই সব চিন্তা তাদের। ভুলে গেলে চলবে না, চীন কিংবা যুক্তরাষ্ট্র আমাদের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক রক্ষা করে সেই প্রেক্ষাপটেই। বাংলাদেশের নির্বাচন কিংবা রাজনীতি তাদের কাছে মুখ্য বিষয় নয়। কূটনৈতিক আচরণের এ বিষয়গুলো বুঝে আমাদের এগোতে হবে।
– ড. দেলোয়ার হোসেন: অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; প্রেষণে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের (পিএসসি) সদস্য হিসেবে নিয়োজিত।
প্রকাশিত প্রতিদিনের বাংলাদেশ [লিংক]