প্রথম ভারতীয় বংশোদ্ভূত, প্রথম অশ্বেতাঙ্গ, প্রথম হিন্দুধর্মাবলম্বী ও ২০০ বছরের মাঝে সর্বকনিষ্ঠ- এমন আরও বেশ কিছু বিশেষণে ভূষিত ঋষি সুনাক গত ২৫ অক্টোবর ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। বিষয়টি শুধু ব্রিটিশ জনগণের মাঝে নয়, বিশ্বজুড়েই আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনে আলোচনা হয়ে আসাটা একটা ঐতিহ্যের মতোই। তবে ঋষি সুনাককে নিয়ে আলোচনার প্রেক্ষাপট বেশ ভিন্ন। এবার দক্ষিণ এশিয়ায়, বিশেষ করে ভারতে এই আলোচনার ঝড় তুঙ্গে। কেননা, একজন ভারতীয় বংশোদ্ভূত হিন্দুধর্মাবলম্বী এবারই প্রথম এই পদে।
ঋষির মতো বৈচিত্র্যময় জীবন আর পারিবারিক ইতিহাসের অধিকারীর পক্ষে প্রধানমন্ত্রীর দৃশ্যপটে আসাটা বেশ কষ্টকর। তার ভারতীয় বাবা-মা পূর্ব আফ্রিকা থেকে ব্রিটেনে আসেন। আর ঠিক এই বৈচিত্র্যের কারণেও দক্ষিণ এশিয়ান, বিশেষ করে ভারতীয় বংশোদ্ভূত ব্রিটিশদের মাঝে উত্তেজনা অন্যদের তুলনায় একটু বেশি পরিলক্ষিত হচ্ছে। এ রকম আলোড়ন শেষ দেখা গিয়েছিল ২০০৮ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা দায়িত্ব গ্রহণের পর। তিনিও ছিলেন অশ্বেতাঙ্গ ও অভিবাসীর সন্তান। আর তাই ইতিহাসের ব্যত্যয় ঘটিয়ে ঋষি সুনাকের প্রধানমন্ত্রী হওয়াটা বিশেষ আবেদনের সৃষ্টি করেছে।
তবে ঋষির জন্য এই দায়িত্ব পালন বেশ সহজ হবে, বিষয়টা এমন নয়। গত চার মাসে ব্রিটেন ক্ষমতার পালাবদল দেখল তিনবার। বরিস জনসন ও লিজ ট্রাস অর্থনৈতিক ভারসাম্য বজায় রাখতে না পেরে চ্যালেঞ্জের মুখে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। এমন ঘন ঘন ক্ষমতার পালাবদল ব্রিটিশ রাজনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা বটে। তার ওপর ঋষি সুনাকের প্রতিদ্বন্দ্বীরা প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেন। তাই তিনি নির্বাচিত বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়। তাই নিজেকে প্রমাণ করার জন্য ঋষিকে যেতে হবে বহু দূর।
ব্রিটিশ অর্থনীতি পার করছে বেশ একটু নাজুক অবস্থা। গোটা বিশ্বই প্রকৃতপক্ষে যাচ্ছে এক অর্থনৈতিক চাপের মধ্য দিয়ে। ব্রিটিশ অর্থনীতির নাজুক অবস্থার পেছনে বেশ কিছু নিয়ামককে চিহ্নিত করা যায়। প্রথমত, ব্রেক্সিটের ধকল এখনো পুরোপুরি পার করতে পারেনি ব্রিটিশ অর্থনীতি। এখনো অর্থনীতির নানা খাতে দেখা যায় অসামঞ্জস্য। রাজনৈতিক টালমাটাল অবস্থাও আছে ব্রেক্সিটকে ঘিরে। ব্রেক্সিট-পরবর্তী সংস্কারগুলোর জন্যও প্রয়োজন বেশ কিছু সময়ের ও বিশেষ পদক্ষপের। দ্বিতীয়ত, করোনা মহামারির আঘাতে ইউরোপে যে কয়টি রাষ্ট্র বেশি ঝুঁকির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, ব্রিটেন তাদের মধ্যে অন্যতম। ফ্রান্স, ইতালির মতো ব্রিটেনও দেখছে অর্থনৈতিক নানা প্রতিকূলতা। অর্থনীতির নানা খাতে দেখা দিয়েছে স্থবিরতা। তৃতীয়ত, ইউক্রেন যুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের সঙ্গে ব্রিটেনের অর্থনীতিও হয়েছে ক্ষতিগ্রস্ত। বেশ একটা চাপের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে জ্বালানি, খাদ্য ও অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজার। মূল্যস্ফীতি পৌঁছেছে সংকটজনক অবস্থানে।
বৈশ্বিক সংকটের সময় প্রতিটি অর্থনীতি পার করছে কঠিন সময়। তবে ব্রিটেনের অবস্থা বেশ একটু নাজুক এই কারণে ব্যালেন্স অব পেমেন্টে ঘাটতি তৈরি হয়েছে। সঙ্গে আছে ক্রমহ্রাসমান বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। দেশটির অভ্যন্তরে দৈনন্দিন জীবন নির্বাহের ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ইউরোপের যেকোনো দেশের চেয়ে বেশি। প্রায় ৯৩ শতাংশ ব্রিটিশ জনগণ মনে করেন, তাদের জীবনযাত্রার খরচ আগের বছরের তুলনায় বেড়েছে। খাদ্যমূল্য বেড়েছে প্রায় ৯২ শতাংশ। জ্বালানি মূল্যবৃদ্ধি পেয়েছে ৮৫ শতাংশ। এই নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজারে স্থিতিশীলতা আনতে ব্যর্থ হওয়া লিজ ট্রাসের ক্ষমতা থেকে সরে যাওয়ার একটি বড় কারণ। কর-ব্যবস্থায় পরিবর্তন ও ভর্তুকির মাধ্যমে সাধারণ জনগণের মাঝে জনপ্রিয়তা বাড়াতে গিয়ে উনি সামষ্টিক অর্থনীতির জন্য ডেকে নিয়ে আসেন এক অশনিসংকেত। যার ফলে ঋষি সুনাকের প্রধানমন্ত্রিত্ব প্রাপ্তি।
ঋষি সুনাক অবশ্য এদিক দিয়ে এগিয়ে থাকবেন তার অভিজ্ঞতার জন্য। তিনি এর আগে চ্যান্সেলর ও অর্থমন্ত্রী থাকার দরুন বুঝতে পারবেন এই সংকট মোকাবিলায় করণীয় সম্পর্কে। তিনি এই অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করতে যেকোনো ধরনের ব্যবস্থা নিতে পিছপা হবেন না। এর জন্য উনি জনগণের আস্থাও অর্জন করতে পারবেন। পরপর তিনবার প্রধানমন্ত্রী পরিবর্তনের মাধ্যমে ব্রিটিশরা ঋষি সুনাককে কিছুটা সময় বেশি দিতে পারেন।
ঋষি সুনাকের সময় অর্থনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেলেও বহির্বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্কে কোনো ধরনের পরিবর্তন লক্ষ্য করার সম্ভাবনা নেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীনের দ্বন্দ্বের ব্যাপারে চীনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতেও দেখা যেতে পারে তাকে। তবে ৪২ বছর বয়স্ক ঋষি তার তরুণ সত্তার কারণে ব্রিটিশ রাজনীতিতে আনবেন গতিশীলতা। এ রকম ঐতিহ্যবাহী একটি গণতন্ত্রে যেখানে প্রাচীনত্ব একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে, সেখানে তার মতো তরুণ নেতৃত্ব একটি নতুন ধারার সংযোজন করবেন, যার মূলে রয়েছে গতিশীলতা। তবে সমালোচকরা বলবেন, বরিস জনসনের আমলের মন্ত্রীদের নিয়ে মন্ত্রিসভা গঠনের ফলে বরিস জনসনের সময়কার নীতি থেকে খুব বেশি সরে আসবে না ঋষি সুনাকের মন্ত্রিপরিষদ। নতুন মন্ত্রিসভায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের পুরোনো মুখগুলোই ফিরে আসছে। গুরুত্বপূর্ণ পদে যারা নিয়োগ পেয়েছেন তাদের বেশির ভাগই বরিস জনসনের আমলেও ছিলেন। ডমিনিক রাব, জেমস ক্লেভারলি, গ্র্যান্ট শ্যাপস, বেন ওয়ালেস, স্টিভ বার্কলে, টেরেজা কফি সবাই ছিলেন জনসনের মন্ত্রিসভায়। এ বিষয়ে বিরোধী লেবার পার্টি বলছে, নতুন সরকারে বরিস জনসন হয়তো প্রধানমন্ত্রী হয়ে ফেরেননি, কিন্তু তার মন্ত্রিসভা ফিরে এসেছে।
আমাদের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো বাংলাদেশ-ব্রিটেন সম্পর্কের নতুন মোড়। যুক্তরাজ্যের নতুন প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাককে অভিনন্দন জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অভিনন্দন বার্তায় তিনি লিখেছেন, এই পদে দক্ষিণ এশীয় ঐতিহ্যের একজন তরুণ ব্রিটিশকে দেখে তিনি আনন্দিত। অতি সম্প্রতি আমরা দেখতে পাই, আমাদের ঐতিহাসিক সম্পর্ক আরও শক্তিশালী হচ্ছে বিভিন্ন নতুন প্রচেষ্টার মাধ্যমে। গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সহনশীলতা আমাদের এক সুতোয় বেঁধে রাখতে সাহায্য করবে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, বাংলাদেশ ও যুক্তরাজ্যের মধ্যে ঐতিহাসিক সম্পর্ক রয়েছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাণিজ্য, বিনিয়োগ এবং টেকসই উন্নয়নে আমাদের দৃঢ় সহযোগিতা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে। দুই দেশ আগামীতে জীবনমান উন্নয়নেও একসঙ্গে কাজ করবে। বাংলাদেশ-যুক্তরাজ্যের সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তিতে দুই কমনওয়েলথভুক্ত রাষ্ট্রের মাঝে মাঝে সম্পর্ক আরও শক্তিশালী হবে বলেই বিশ্লেষকরা মনে করেন।
এখানে বলে রাখা ভালো, যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশের একটি শক্তিশালী অভিবাসীগোষ্ঠী রয়েছে যারা দেশটির অর্থনীতিতে বেশ শক্তিশালী ভূমিকা রেখে চলেছে। সম্পর্কের সেতুবন্ধন হিসেবে এই গোষ্ঠী অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা যায়। যুক্তরাজ্যে প্রবাসী বাংলাদেশিরা দুই দেশের উন্নয়নে সাধারণ সম্পদ।
ইন্দো-প্যাসিফিকের গুরুত্ব বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের গুরুত্বও বাড়বে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর কাছে। ইন্দো-প্যাসিফিককে তিনি বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছেন। এই গুরুত্ব বাংলাদেশকে সাহায্য করবে যুক্তরাজ্য থেকে আরও বেশি বিনিয়োগ প্রাপ্তিতে, বাণিজ্য বৃদ্ধিতে ও সর্বোপরি বাংলাদেশ-যুক্তরাজ্য সম্পর্ককে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যেতে। সম্প্রতি সামরিক ও নিরাপত্তা ইস্যু নিয়ে দুই দেশের মধ্যে আলোচনায় এমনটি ধারণা পাওয়া যাচ্ছে। ঋষি সুনাকের দায়িত্ব গ্রহণের মাধ্যমে যে বহুমাত্রিক সম্পর্কের দ্বার উন্মোচন হলো সেখানে দক্ষিণ এশিয়া, বিশেষ করে ভারতের ভূমিকাই সর্বাপেক্ষা মুখ্য। কিন্তু বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার দেশ হিসেবে অন্যান্য দেশ থেকে খানিকটা বেশি গুরুত্ব পাবে বলেই ধারণা করা যায়। তবে সর্বোপরি ধারণা করা যায়, যুক্তরাজ্যের অর্থনীতি ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও ঋষি সুনাক তাতে নতুন গতি সঞ্চারের চেষ্টায় নতুন কোনো চমক না আনলেও তার তারুণ্যের কারণে এক নতুন গতিশীলতা পাবে অর্থনীতি। যেমনটি দেখা গিয়েছিল বিল ক্লিনটন বা বারাক ওবামার সময়।
যুক্তরাজ্যের ইতিহাসের এক সন্ধিক্ষণে দায়িত্বভার গ্রহণ করেছেন ঋষি সুনাক। আগামী ২০২৪ সালে তাকে লড়তে হবে নির্বাচনে। তার আগে তাকে মোকাবিলা করতে হবে অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক বহু প্রতিকূলতার। তাই তার শাসনামল নানা দিক থেকে তাৎপর্যপূর্ণ। তবে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক আরও বেগবান ও কার্যকর হোক, এটাই আমাদের প্রত্যাশা। দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় প্রতিটি দেশই প্রবল আগ্রহে অপেক্ষা করে আছে সম্পর্কের নতুন দিগন্ত উন্মোচনের আশায়। আমরাও ব্যতিক্রম নই। ভারতকে কেন্দ্র করে হলেও এই সম্পর্কের উন্নয়ন বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতিতে আমাদের জন্য কার্যকরী ফলাফল বয়ে আনতে পারে।
– ড. দেলোয়ার হোসেন: অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; প্রেষণে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের (পিএসসি) সদস্য হিসেবে নিয়োজিত।
প্রকাশিত দৈনিক বাংলা [লিংক]